আলোয় আঁধার
আলোয় আঁধার
অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর পুরোদস্তুর দু’টো ডিভিশন। ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি, মর্টার, হেভি মেশিনগান, গ্রেনেড, স্টেনগান, কার্বাইন। আর্টিলারির পাশাপাশি বিধ্বংসী এয়ার ফোর্স। যাদের এক-একটা উড়ানে শয়ে শয়ে বোমার ঘায়ে বিস্তীর্ণ ভূমি ধুধু শ্মশান।
কাদের সঙ্গে যুদ্ধ?
না, বিপক্ষে অন্য কোনও রাষ্ট্রের ফৌজ নয়। নিজের দেশেরই সাধারণ মানুষ। যারা ধর্মের উপরে ভাষাকে ঠাঁই দিতে চেয়েছে। ভাষাগত, সংস্কৃতিগত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বুক ঠুকে বলেছে, বাংলা আমার ভাষা। বাংলা আমার ঠাঁই। ধর্মের দোহাই দিয়ে এখানে ঊদুর্ভাষীর দাদাগিরি চলবে না।
এত সাহস?
পরিণামে অপারেশন সার্চলাইট। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ‘বেয়াদপ’ বাঙালিদের শিক্ষা দিতে যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ঊর্দু শাসকেরা। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মাঝরাতে শুরু হওয়া ওই সেনা অভিযান পূর্ণোদ্যমে চলে অন্তত তিন মাস, ততদিনে নিহত নয় নয় করে ৩০ লাখ বাঙালি, ভিটেহারা প্রায় এক কোটি, ধর্ষিতা কম করে পাঁচ লাখ। হিটলারের ইহুদি হলোকাস্ট, কম্বোডিয়ায় খেমের রুজের কিলিং ফিল্ডস বা রোয়ান্ডা-বুরুন্ডির গণহত্যা নিয়ে এপারের আধুনিককালের বিদগ্ধ বাঙালি চায়ের কাপে হরবখত তুফান তোলে। কিন্তু ঘরের দুয়ারে ঘটে যাওয়া মানব ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়টি সম্পর্কে আশ্চর্য ঔদাসীন্য। আপন ভাষা সম্পর্কেও তা-ই। যাই হোক, অপারেশন সার্চলাইটের ‘সুবর্ণজয়ন্তী’তে সে সময়টাকে একঝলক ফিরে দেখার চেষ্টা করলে বোধহয় ক্ষতি কিছু নেই।
দেশভাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এল, ভাগ হল বাংলাও। অদ্ভুত ভাগ! ভারতভূমির পশ্চিম সীমান্তে গজিয়ে ওঠা নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ হয়ে পূর্ব প্রান্তে ঝুলে রইল দ্বিখণ্ডিত বঙ্গভূমির একটি খণ্ড। পূর্ব বাংলা, তথা পূর্ব পাকিস্তান। সুদূর করাচি-রাওয়ালপিন্ডিতে বসে পশ্চিমের পাঞ্জাবি-বালুচ-সিন্ধি প্রভুরা পুবের কোটি কোটি বাঙালির ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠলেন রাতারাতি, রাজনীতির কলমের এক খোঁচায়। শুরু হল ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের ঘৃণ্য এক পর্ব, বাঙালির আপাদমস্তক ঊর্দুকরণের প্রয়াস। সরকারি ক্ষেত্রে বাংলার বদলে অগ্রাধিকার ঊর্দুকে। বাঙালির মন, বাঙালির কৃষ্টিকে বিনাশ করার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো মোহাজিরদের উপদ্রব। মানে, বিহারি মুসলিম। দেশভাগের পর যারা কিনা সুখের আশ্রয় হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানকে বেছে নিয়ে লাখে লাখে সেখানে ডেরা বেঁধেছে। ধর্ম এক হলে কী হবে, তাদের ভাষা থেকে সংস্কৃতি, চালচলন থেকে আদবকায়দা, সবই বাঙালির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। তেলে জলে কি মিশ খায়? খায়ওনি। ক্রমে ওই বিহারিরা হয়ে ওঠে মূর্তিমান আপদ। বাঙালিকে তাঁবে আনতে পশ্চিমের শাসকদের বড় হাতিয়ারও। তাদের প্রশ্রয়ে বিহারিদের বাড়বাড়ন্ত ঘটতে থাকে, বাড়তে থাকে বাঙালির উপর অত্যাচার। হামেশাই বাঙালিবিরোধী দাঙ্গার আয়োজন। বিশেষত চটকলের ঊর্দুভাষী বিহারি শ্রমিকরা আমজনতার ত্রাস হয়ে ওঠে। রেডিওয় মহম্মদ রফির গান শোনার অপরাধে বাঙালি মুসলিম পান দোকানিকে কুপিয়ে কোতল করেছে বিহারি মুসলিমরা, এমন দৃশ্যেরও সাক্ষী থেকেছে পূর্ব পাকিস্তান। ঘাতকদের যুক্তি, রফি বিধর্মী, কারণ তিনি ভজন গেয়েছেন!
এমতাবস্থায় উল্টো দিকে যে বিতৃষ্ণার মেঘ ঘনাবে, তাতে আশ্চর্য কী?
বাঙালির আপন ভাষা, আপন সংস্কৃতির দাবিতে ক্রমে প্রতিবাদ দানা বাঁধে। ছাত্র-যুবদের বাংলা আন্দোলনের পাশাপাশি শুরু হয় পাল্টা মার। বাঙালির রুদ্ররূপ দেখে মোহাজিরের দল ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। অশনি সঙ্কেত যায় রাওয়ালপিন্ডিতে। জুলুমের বাঁধন আরও কড়া হয়ে চেপে বসে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে প্রতিবাদের ঝড়। ১৯৭০ সালের পাক পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামি লিগের অপ্রত্যাশিত সাফল্যে পশ্চিমী প্রভুদের কপালের ভাঁজ আরও গভীর। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বাঙালির ন্যায্য অধিকারের দাবি আরও জোরালো। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রমাদ গোনেন। ভেতো বাঙালির স্পর্ধা দেখে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, তথা বিরোধী নেতা জুলফিকর আলি ভুট্টোরও ক্রোধের অন্ত নেই।
‘পার্মানেন্ট সল্যুশনের’ চিন্তাভাবনার তখনই সূত্রপাত। সমস্যার স্থায়ী সুরাহা। জাতটার শিরদাঁড়া চুরচুর করে গুঁড়িয়ে দাও, যাতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তারই ফলশ্রুতি, অপারেশন সার্চলাইট। সেনাবাহিনী এনে জনসাধারণের উপর অবাধ হত্যালীলা।
পাক সেনার ইস্টার্ন কমান্ডের ‘বিশেষ অভিযানে’ সাহায্য করার জন্য একাত্তরের মার্চের গোড়ায় কোয়েটায় মোতায়েন পাক সেনার প্রসিদ্ধ ফিফটিন্থ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন ও খারিয়নে মোতায়েন নাইন্থ ডিভিশনকে ইস্ট পাকিস্থানে মুভ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সাজ সাজ রব পড়ে বিমানবাহিনীতে। উড়িয়ে আনা হয় বাড়তি বোমারু স্কোয়াড্রন। পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর তথা পাক সেনার ইস্টার্ন কমান্ডের সেনাধ্যক্ষ লেফটেনান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সার্বিক নেতৃত্বে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে একপাল ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো পাক ফৌজ ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা শহরে।
সে পাশবিকতা, সে নারকীয়তার বিবরণ দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। সংক্ষেপে বলা যায়, জান্তব প্রবৃত্তির শেষ সীমা দেখে ফেলেছিল পূর্ব পাকিস্তান। বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অন্যতম নিশানা। নিরস্ত্র শয়ে শয়ে ছাত্র, শিক্ষককে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। গার্লস হস্টেলে ঢুকে নির্বিচার ধর্ষণ, খুন। আর্মি, প্যারা মিলিটারি, পুলিশের অধিকাংশ বাঙালি কর্মীকে আগেই নিরস্ত্র করে আটক রাখা হয়েছিল, তাদের গুলি করে মারা হয়। যৎসামান্য অস্ত্রবল নিয়ে যাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, ট্যাঙ্কের সামনে তাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। শেখ মুজিবকে জেলে পোরা হয়।
প্রাথমিক প্রতিরোধ চূর্ণ করার পর টার্গেট সাধারণ মানুষ। বাংলা যাদের রক্তে, যার তেজে ওরা রাওয়ালপিন্ডিকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করে! হিন্দু-মুসলিম কোনও ফ্যাক্টর নয়, ওদের একটাই পরিচয়, বাঙালি। এদের শেষ রাখব না। বস্তুত এক মাস বাদে টিক্কা খানের জায়গায় পাক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় পা দিয়ে লেফটেনান্ট জেনারেল নিয়াজির সদর্প ঘোষণা ছিল, “এই বজ্জাত বাঙালি জাতটার হুলিয়া পাল্টে দেব।”
কথায় কাজে ফারাক রাখেননি। সেনাকে খুন, লুঠ, ধর্ষণের অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে সোনার বাংলাকে শ্মশান বানানোর কাজে নেমে পড়ে পশ্চিমা হানাদারের দল। রক্তলোলুপ, নারীমাংসলোলুপ নেকড়ের মতো আমবাঙালির উপর লেলিয়ে দেওয়া হয় পঞ্জাব রেজিমেন্ট, বালুচ রেজিমেন্টকে। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে যায় বিহারিরা। তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কিছু বাঙালি বেইমানও (কোলাবরেটর) স্বজাতি বিনাশের যজ্ঞে শামিল হয়। বিভিন্ন মহল্লায় নাম ধরে ধরে খতম তালিকা তৈরি হয়েছিল তাদেরই মদতে।
সেই তালিকা কাজে লাগে মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম পর্বে, যখন পতনের আঁচ পেয়ে গিয়েছেন নিয়াজি। অপারেশন সার্চলাইটের নতুন সেই পর্বের লক্ষ্য, বঙ্গসংস্কৃতির ভিত গুঁড়িয়ে দেওয়া। তামাম বুদ্ধিজীবী মহল, অর্থাৎ ইন্টেলেজেন্সিয়াকে চিরতরে নিকেশ। যাতে পরবর্তী প্রজন্মের মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা বলে কিছু না থাকে। এগুলোই বাঙালিকে এগিয়ে রেখেছে কিনা! কম ঈর্ষা?
অতএব খতম কর। লিস্ট ধরে ঘরে ঘরে হানা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, কবি, লেখক, চিত্রকর, পরিচালক, সাংবাদিক, অধ্যাপক.. নাম ডেকে ডেকে বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বদের তুলে আনা। চোখ বেঁধে, পিছমোড়া করে গাড়িতে তুলে টর্চার চেম্বারে চালান। অমানুষিক নির্যাতনের পর মগজে একটি করে বুলেট। অনেকটা নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতো। একদল পণ্ডিত বেলচা কোদাল হাতে গর্ত খুঁড়ছেন, জানেন খোঁড়া শেষ হলেই নিজের বুলেটবিদ্ধ লাশ গড়িয়ে পড়বে তার অন্দরে, মাটি চাপা দেওয়ার জন্য পিছনে অপেক্ষা করছেন আর এক দল।
একাত্তরের শেষ ভাগে পূর্ব পাকিস্তানে হাজারের বেশি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানীকে এ ভাবে খুন করা হয়। নিয়াজির মরণ কামড়।
অতি, অতি সংক্ষেপে এ-ই হল অপারেশন সার্চলাইটের নির্যাস। এ বিষয়ে বহু বই, বহু লেখা, বহু সিনেমা, নাটক, উপন্যাস রয়েছে। অবর্ণনীয় এক ক্রান্তিকালের দলিল সব। পড়তে পড়ে শিউরে ওঠার সঙ্গে আশ্চর্যও হতে হবে একালের বাঙালিকে। ভাষা, স্রেফ মাতৃভাষার খিদে মেটতে জীবন বাজি রেখেছিল বাঙালি? হয় নাকি?
ঘটনাচক্রে পঞ্চাশ বছর বাদে বাংলাভাষা, সংস্কৃতি, আপামর বাঙালিসত্তা ফের অস্তিত্বের সঙ্কটে। পঞ্চাশ বছর আগের পরিস্থিতিও যেন আড়ালে-আবডালে উঁকিঝুঁকি মারছে। ধর্মীয় একাত্মতার বিষ-জিগির তুলে ভিনভাষীর আধিপত্যবাদ, সরকারি ক্ষেত্রে বিজাতীয় ভাষার জবরদস্তি প্রয়োগ, সুজলা-সুফলা বঙ্গভূমির উপর লোলুপ নজর, পদলেহী কিছু স্বার্থান্ধ বেইমান রাজাকার কোলাবরেটরের জিভ চাটা, সব কিছুরই মিরর ইমেজ যেন ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। বাঙালির অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেওয়ার মহা মওকা কখন আসে, মাটিতে থাবা ঘষে ঘষে তার প্রতীক্ষা।
সমাপতন? হতেও পারে।
লেখা টি সংগ্রহীত অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় বাবুর ফেসবুক থেকে।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন