৩০০ নিরক্ষর পড়ালেখা শিখলো জাদুকরী উপায়ে মাত্র দেড় মাসেই
‘শিক্ষা পৃথিবীকে পরিবর্তন
করে না বরং সুশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাই পৃথিবীকে বদলায়।’এই কথাগুলো সেই ব্যক্তির
যিনি নিজেই শুধু শিক্ষিত হতে চাননি, পৃথিবীর সব মানুষকে সুশিক্ষিত করার তুলতে শিক্ষাব্যবস্থার
উন্নতি ঘটিয়েছেন। পৃথিবীতে শাসক ও শোষিতের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। উপনিবেশবাদের সময় এ দ্বন্দ্বের
মাত্রা ছিল চরমে। আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রাথমিক ফলাফল হিসেবে উচ্চাভিলাষী দেশগুলো
দখল করে নেয় অপেক্ষাকৃত শান্তিপ্রিয় ও দুর্বল দেশগুলোকে। শুরু হয় সবলের ওপর দুর্বলের
অত্যাচার ও বঞ্চনা। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থায়। শাসক দেশগুলো তাদের অন্তর্ভুক্ত
উপনিবেশ দেশগুলোর শিক্ষা কাঠামো এমনভাবে তৈরি করত যাতে করে উপনিবেশের মানুষদের শিক্ষিত
হওয়ার পরেও শাসকদের গোলামি করতে হতো। এই প্রক্রিয়ায় যে ব্যক্তি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন
তিনি পাওলো ফ্রেইরি। তিনি ছিলেন একজন ব্রাজিলিয়ান শিক্ষক ও দার্শনিক। ক্রিটিক্যাল
পেডাগোজির একজন অগ্রগামী সমর্থক ও পথপ্রদর্শক ছিলেন পাওলো। ক্রিটিকাল পেডাগোজি হলো
শিক্ষার এক বিশেষ দর্শন। একে এক ধরনের সামাজিক আন্দোলনও বলা চলে। এর সর্মথকরা শিক্ষণকে
এক ধরনের সহজাত রাজনৈতিক কাজ হিসেবে দেখেন।
তারা জ্ঞান বা শিক্ষাকে
নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন না। তাদের মতে, সোশ্যাল জাস্টিস ও গণতন্ত্রের সঙ্গে
শিখন ও শিক্ষণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পাওলো ফ্রেইরির জন্ম ১৯২১ সালে ব্রাজিলের রেসিফেতে।
তার জন্মের কিছুকাল পরেই বিশ্বজুড়ে গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দা শুরু হয়েছিল। ক্যাপিটালিজম
বা পুঁজিবাদের প্রসারের কারণে বিশ্বব্যাপী তীব্র ব্যবসা সংকট তৈরি হয়। এর ফলে সমাজের
নিচের শ্রেণীর মানুষরা আরও সহায়-সম্বলহীন ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। পাউলো ফ্রেইরি ছিলেন
এমনই এক পরিবারের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই নিত্যদিনের অভাব ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। ১৩
বছর বয়সে ফ্রেইরির বাবা পরলোকগমন করেন। কৈশোরে ব্রাজিলের অন্য দশটা দরিদ্র কিশোরের
মতো পাওলো ফ্রেইরিও তার বস্তির বন্ধুদের সঙ্গে অলিতে গলিতে ফুটবল খেলে বেড়াতেন। তার
সামাজিক জীবনের অনেকটা জুড়েই ছিল বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলার সময়টা। পরবর্তী জীবনে
তিনি স্বীকার করেন, ওই দিনগুলোতে তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ শিক্ষা পেয়েছেন। ফ্রেইরি
বলতেন, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা তার শেখার ক্ষমতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ভীষণ অভাবের
ওই দিনগুলোই পরবর্তীতে তাকে দরিদ্র ও শোষিতদের জন্য কাজ করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
পাওলো ফ্রেইরি
ফ্রেইরি বলেছিলেন, ক্ষুধার কারণে কোনো পড়াশোনাই আমার মাথায়
ঢুকতো না। এমন না যে আমি বোকা ছিলাম, অথবা আমার আগ্রহের কোনো কমতি ছিল। আমার সামাজিক
অবস্থা আমাকে শিক্ষা নিতে দেয়নি। যদিও পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালে রেসিফে বিশ্ববিদ্যালয়ের
আইন স্কুলে পড়ার সুযোগ পান ফ্রেইরি। সেখানে তিনি দর্শন ও মনোবিজ্ঞান বিষয়েও পড়াশোনা
করেন। ১৯৬১ সালে পাওলো ফ্রেইরি রেসিফে বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের
দায়িত্ব পান। ১৯৬২ সালে ফ্রেইরি প্রথমবারের মতো তার থিওরি বড় স্কেলে প্রয়োগের সুযোগ
পান। তার থিওরি প্রয়োগের এক্সপেরিমেন্টের অংশ হিসেবে তিনি ৩০০ জন নিরক্ষর আখ চাষীকে
৪৫ দিনের মধ্যে পড়ালেখা শেখাতে সক্ষম হন।
শিক্ষায় অবদান
শিক্ষা ক্ষেত্রে পাওলো ফ্রেইরি এমন এক দর্শনের সঙ্গে বিশ্ববাসীকে
পরিচয় করিয়ে দেন যা ছিল একাধারে প্লেটোর ক্লাসিকাল স্টেমিং থেকে শুরু করে আধুনিক মার্কসিস্ট,
পোস্ট-মার্কসিস্ট ও উপনিবেশবাদবিরোধী চিন্তাবিদদের চিন্তার একটি সমন্বয়। ১৯৬৮ সালে
প্রকাশিত হয় পাওলো ফ্রেইরির জগদ্বিখ্যাত বই ‘Padagogy of the opressed’। বইটিতে ফ্রেইরি
প্রচলিত শিক্ষণ ব্যবস্থাকে ‘ব্যাংকিং মডেল অব এডুকেশন’ বলে আখ্যা
দেন। কারণ প্রচলিত শিখন ও শিক্ষণ পদ্ধতিতে
শিক্ষার্থীদের ‘শূন্য কলসি’ হিসেবে গণ্য করা হয়।যেখানে শিক্ষকের কাজ শুধু সেই কলসি ভর্তি
করা। ফ্রেইরির মতে, শিক্ষার্থীদের ফাঁকা কলসি হিসেবে গণ্য না করে তাদের জ্ঞানের কো-ক্রিয়েটর
হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। Padagogy of the opressed বইটিতে ফ্রেইরির দর্শন
critical padagogy খুব বেশিমাত্রায় লক্ষণীয়। বিশ্বজুড়ে বইটি সাড়ে সাত লাখেরও বেশি কপি
বিক্রি হয়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় অনন্য অবদানের জন্য জীবদ্দশায় পাওলো ফ্রেইরি বহু পুরষ্কার
ও সম্মাননা লাভ করেন। এদের মধ্যে ১৯৮৬ সালে তার পাওয়া ইউনেস্কো প্রাইজ ফর পিস এডুকেশন
অন্যতম। ১৯৯৭ সালের ২ মে সাওপাওলোতে পাওলো ফ্রেইরি ৭৫ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন